ধর্ষণ শুধু যৌনতা নয়, ক্ষমতারও প্রকাশ

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, জিটিভি
প্রকাশিত : শনিবার, ২০২১ নভেম্বর ১৩, ০৩:৪০ অপরাহ্ন

ধর্ষণের খবরের নির্মাণ কী বদলে যাচ্ছে? দীর্ঘ দিন খবর ভাঙা-গড়ার কাজটা করছেন সাংবাদিকরা। ভুল শুদ্ধ অনেক কিছুকে সাথী করে সাংবাদিকরা ধর্ষণসহ সব ধরনের নারীর নির্যাতনের খবর করে গেছেন। সাথে ছিল সমাজ। তাদের নিরন্তর নির্মাণের ফলেই ধর্ষণের খবরগুলো বেশি করে উঠে আসছে।

কিন্তু হঠাৎ করে মনে হচ্ছে ধর্ষণের খবর করা আবার জটিল হয়ে উঠছে। রেইন ট্রি হোটেল ধর্ষণ কাণ্ডে অভিযুক্তরা সবাই ছাড়া পেয়েছে। তারা বেশ উৎফুল্লভাবে বেরিয়ে যাবে। মামলার প্রসিকিউশন দুর্বলতা, তদন্ত দুর্বলতায় অনেক অপরাধই শেষ পর্যন্ত প্রমাণ করা যায় না। কিন্তু আদালতের পর্যবেক্ষণে যখন পুলিশকে বলা হয় যে, ৭২ ঘন্টা পার হলে ধর্ষণ মামলা না নিতে, তখন ধর্ষণ সম্পর্কে নতুন করে সামাজিক ধারণা নির্মিত হয়। আদালত যখন বলে – ‘মামলার দুই ভিকটিম বিশ্বাসযোগ্য নয়। ভিকটিম দুজনই আগে থেকেই সেক্সুয়াল কাজে অভ্যস্ত’ তখন নতুন করে নারীদের নিয়ে ধারণা নির্মিত হয়।

আদালতের পর্যবেক্ষণে যখন পুলিশকে বলা হয় যে, ৭২ ঘন্টা পার হলে ধর্ষণ মামলা না নিতে, তখন ধর্ষণ সম্পর্কে নতুন করে সামাজিক ধারণা নির্মিত হয়। আদালত যখন বলে – ‘মামলার দুই ভিকটিম বিশ্বাসযোগ্য নয়। ভিকটিম দুজনই আগে থেকেই সেক্সুয়াল কাজে অভ্যস্ত’ তখন নতুন করে নারীদের নিয়ে ধারণা নির্মিত হয়।

আদালতের এ ধরনের পর্যবেক্ষণে আমাদের সমাজে নারী নির্যাতনের ঘটনা আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হলো। এমনিতেই সামাজিক প্রেক্ষাপটের কারণে মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হলে সহজে মুখ খোলেন না, মামলা করতেও তাদের বারবার ভাবতে হয়। ধর্ষকরা প্রভাবশালী হলে মেয়েদের জন্য ন্যায় বিচার পাওয়ার পথ অনেকটাই রুদ্ধ হয়ে যায়। অনেক ঘটনাই সামাজিকভাবে, এমনকি পুলিশের হস্তক্ষেপে তথাকথিত সালিশের মাধ্যমে মীমাংসার চেষ্টা করা হয়। মামলা নিতে পুলিশের গড়িমসির অভিযোগও পুরোনো। আবার প্রান্তিক পর্যায়ের মেয়েরা বেশিরভাগ সময়ই সামাজিক বা আইনি কোনো সংগঠনের সাহায্য ছাড়া ধর্ষণের মামলা দায়ের করতেই পারেন না। এমন পরিস্থিতিতে ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পর মামলা না নিতে বিচারকের ‘পরামর্শ’ গোটা প্রক্রিয়াটিকে আরও জটিল করে তুলবে। আদালতের এমন পরামর্শ আরও সংশয় তৈরি করবে। আদালত তদন্তের দুর্বলতার দিকে দৃষ্টি না দিয়ে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মামলা না করলে মামলা না নেওয়ার পরামর্শ সুবিবেচনাপ্রসূত বলে মনে হয়নি। এর ফলে ধর্ষক ৭২ ঘণ্টার বেশি সময় ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করতে পারে। তাছাড়া ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সবার পক্ষে মামলা করতে আসা সম্ভবও না। বিশেষ করে প্রান্তিক এলাকার ক্ষেত্রে, যেটি আমরা বেগমগঞ্জের ঘটনায় দেখেছি।

আসলে কারও পরিবারে কেউ - শিশুকন্যা, বালকপুত্র, তরুণী বোন, স্ত্রী, এমনকী প্রৌঢ়া মা যদি ধর্ষণের শিকার না হয়ে থাকে তাহলে ধর্ষক বিষয়ে মানবিক সহানুভূতি থাকা দোষের কিছু নয়। বরং ধর্ষিতার মৃত্যুকামনা করাই আমাদের হৃদয়ের ব্যাপ্তি প্রমাণ করে। ধর্ষিতাকে এ সমাজ, পরিজন, এমনকী সে নিজে কী চোখে দেখে সেটা নতুন করে উঠে এলো বুঝি।

আমরা ভাবছিলাম বাংলাদেশের সমাজ এখন আর সম্পূর্ণভাবে পুরুষতন্ত্র ও তার ধ্বজাধারীর কবলে নেই। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানুষকে লিঙ্গপরিচয়ের ঊর্ধ্বে দেখার চোখ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু কোথাও বুঝি ভুল হচ্ছে আসলে। আমাদের সমাজে ধর্ষিতাকে শাস্তি দেওয়ার আইন নেই কিন্তু রেওয়াজ আছে। সেই রেওয়াজটা শক্তিশালী করছি কিনা সেটা ভেবে দেখা দরকার। ধর্ষণের ঘটনায় অপরাধ ধর্ষকের; দোষ, পাপ, অন্যায়, অনৈতিকতা ধর্ষকের – এ কথাটা জোর গলায় বলতে পারব কিনা সে নিয়েও সংশঙ সৃষ্টি হচ্ছে।

ধর্ষকের শাস্তি কী বা কত দূর হওয়া উচিত সেটা আইনের বিষয়। কিন্তু এখন আমাদের বিবেচনা করতে হবে ধর্ষণের শিকার নারীর প্রতি সমাজের বিবিধ বিচিত্র মনোভাব। ধর্ষকের মনোভাব বা চিত্তশুদ্ধি ও সংশোধন সম্ভব কি না সে আলোচনা আর নাইবা হোক। একটি মেয়ে শুধু কিছু মাংস ও যৌন পুতুল এই মনোভাবের উৎস কোথায় সেটা জানার চেষ্টাও আর না করি।

ধর্ষণ এমনই এক মর্মবিদারী অপমানজনক এবং অপরিমেয় পীড়াদায়ক ঘটনা, এমনই সুদূরপ্রসারী তার পরিণাম যে, যারা সেই পরিণাম কাছ থেকে দেখেননি, ধর্ষকের প্রতি তাদের ক্রোধ, ঘৃণা, প্রতিশোধস্পৃহা কখনও তাদের সমান হবে না যারা সেই দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছেন। পথে-ঘাটে চলাফেরাকালীন বিকৃত পুরুষের নোংরা ইঙ্গিত বা ছুঁয়ে দেওয়ায় ঘৃণা সঞ্চার করে, তীব্র ক্রোধ জাগায়, অপমানের সঙ্গে অসহায়তার গা রি-রি করা ভাব মনে লেগে থাকে দিনের পর দিন। দণ্ডবিধানের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই অনুভূতি। সেই অনুভুতি কী জাগাতে পারে বিচার ব্যবস্থা?

ধর্ষণ কাণ্ডে অপরাধীর কঠিন শাস্তি চায় সবাই। তবে এর চেয়ে বেশি জরুরি মনে রাখা যে, সম্মান মৃত্যুর চেয়ে বড়। ধর্ষণে এক জন ব্যক্তির যে চরম অপমান অসম্মান, আর কোনও ঘটনাই তার তুল্য নয়। তাই, ধর্ষকের শাস্তি দানের প্রচেষ্টায় কোথাও যেন খাদ না থাকে, কোন পর্যবেক্ষণে যেন ভুক্তভোগীদের অসন্মান না করা হয়। ধর্ষণ মূলত পুরুষের যৌনতার প্রকাশ নয়, ক্ষমতার প্রকাশ। সে কথা যেন বারবার প্রমাণিত হয় আমাদের সমাজে।


প্রধান সম্পাদক : Arka Hossain

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় :

Epic Ettehad Point [Level-4] 618 Nur Ahmed Road Chattogram-4000.

 Newsroom : +88 01703 930636
 E-mail : faguntelevision@gmail.com

Copyright © 2021 www.fagun.tv । ফাগুন টিভি
Design & Developed by Smart Framework